নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যা - শিশুর যত্নের জন্য প্রাথমিক করণীয়

আমাদের দেশে সাধারণত নবজাতক জন্মের আগে থেকেই বা জন্মের পর থেকেই বাবা-মা এবং পরিবার নবজাতকের যত্ন নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। নবজাতক ঠিকমতো দুধ পাচ্ছে কিনা, যদি না পায় তাহলে কি করণীয়, বুকের দুধের পাশাপাশি প্রসেসড মিল্ক দেয়া যাবে কিনা এ সকল বিষয় নিয়ে সাধারণত নবজাতকের বাবা-মা দুশ্চিন্তা করে থাকেন।

নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যা

আমরা আমাদের আজকের আলোচনায় নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যা নিয়ে কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি। নবজাতকের যত্নের জন্য প্রাথমিকভাবে করণীয়গুলো কি হতে পারে সেই বিষয়গুলো আপনাদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

শিশুর সুরক্ষার জন্য প্রথম দুধ

নবজাতকের জন্মের পর প্রথম দুই বা তিন দিন মায়ের বুকে যে ঘন হলুদ অল্প পরিমাণে দুধ আসে সেটাকে বলে শাল দুধ। আর এই শাল দুধ শিশুর সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় নবজাতকের পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজন দুশ্চিন্তা করে থাকেন যে অল্প পরিমাণে দুধে নবজাতকের পেটের ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে কিনা। বিশেষজ্ঞদের মতে এই অল্প পরিমাণ শাল দুধে একটি শিশুর জন্য সকল পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান এবং এই শাল দুধ নবজাতকের জন্মের ২/৩ দিন পর্যন্ত সকল চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। তাই নবজাতকের জন্মের পর মায়ের বুকের প্রথম দুধ শিশুকে টেনে খেতে দেওয়ার চেষ্টা করুন।

উপযুক্ত বিকাশের জন্য সেবা যত্ন

প্রথম ৬ মাস শিশুর পুষ্টির প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিশেষ যত্নের দরকার। শিশুর জন্মের থেকে প্রথম ৬ মাস তার পুষ্টির সকল চাহিদা মেটায় মায়ের বুকের দুধ। তাই শিশুর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ ব্যতিত অন্য কোন খাবার দেয়া থেকে বিরত থাকুন। শিশু যাতে পর্যাপ্ত দুধ পায় সেজন্য মায়ের খাবারের দিকে যত্ন নেয়াটা জরুরী। এই সময় বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধি পায় এমন খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। এতে শিশুর উপযুক্ত বিকাশের জন্য পুষ্টির চাহিদা মিটবে।

বুকের দুধ সম্পর্কে পাঁচটি প্রধান তথ্য

  • জন্মের পর পরই শিশুকে বুকের প্রথম শাল দুধ খাওয়ান।
  • গর্ভবতী ও প্রসূতি মা আপনার পুষ্টি ও শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য অধিক পরিমাণে খাবার খান।
  • ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধই যথেষ্ট।
  • ছয় মাস পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে পরিবারের অন্যান্য খাবার খাওয়ান।
  • যে কোন অসুখে শিশুকে বুকের দুধ ও অন্যান্য খাবার বারে বারে খেতে দিন।

প্রথম শক্ত খাবার শুরুর জন্য বিশেষ যত্ন

৬ মাস বয়সের পর শিশুকে মায়ের দুধের সঙ্গে শক্ত খাবার দেওয়া আরম্ভ করুন। এটা শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করবে। শিশুর বয়স ৬ মাস পার হলেই তার শারীরিক বৃদ্ধি ও মেধাবিকাশের জন্য পুষ্টির চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এই সময় শিশুর শুধুমাত্র বুকের দুধে চাহিদাগুলো পূরণ হয় না। তাই শিশুর বয়স ৬ মাস পার হওয়ার সাথে সাথেই বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবারের তালিকা ঠিক করে বাড়তি খাবার দিন।

৬ মাস বয়স থেকে শিশুকে সবজি খিচুড়ি, মুরগি খিচুড়ি, সুজি, পায়েস, মাছ, ডিমের পাতলা নরম হালুয়া, ফলের রস, সেদ্ধ করা সবজি ইত্যাদি বানিয়ে খাওয়াতে পারেন। এ সকল খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন ফল যেমন- কলা, বেদানা, আঙ্গুর, আপেল, পাকা পেঁপে, কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি খাওয়াতে পারেন। তবে মনে রাখবেন যে কোনো খাবারই বুকের দুধের পাশাপাশি দেয়ার শুরুতে অল্প অল্প পরিমাণে দিয়ে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে।

বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন

শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অন্তত ২ বছর বয়স অবধি শিশুকে সঠিক খাবার দিন। সেটা শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সমস্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সংস্থা বলেন মায়ের দুধে শিশুর পক্ষে সবচেয়ে ভালো। যদি কোন কারনে আপনি স্তন্যপান না করাতে পারেন তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

নবজাতক এর কিছু সমস্যা ও তার প্রাথমিক করণীয়

শিশুর জন্মের পর সাধারণ কিছু সমস্যা প্রায় সকল শিশুর ক্ষেত্রেই দেখা দিতে পারে। এই সমস্যাগুলো খুবই সাধারণ এবং প্রায় সকল শিশুর জন্মের পরপর এগুলো সমস্যাগুলো হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলো শিশুর শারীরিক ও পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার অবস্থার কারণে হয়। অনেক সময় অভিভাবকের অসচেতনতা বা অজ্ঞতার কারণেও হয়ে থাকে। নিম্নে কিছু সমস্যা এবং করণীয় উপদেশ সমূহ উল্লেখ করা হলো।

জরের সময় করণীয় উপদেশ

  • জ্বর হলে জামা-কাপড়, দরজা-জানলা খুলে দিবেন ফ্যান ছেড়ে দিবেন।
  • Drop Ace (30ml), মিলি ৮ ঘণ্টা পরপর ০৩ দিন।
  • Tab. Sedil (5mg), বড়ি ৮ ঘন্টা পরপর ০৩ দিন।
  • জ্বর 101 F হবার সাথে সাথে কুসুম কুসুম গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে সমস্ত শরীর ও মাথা ৩-৫ মিনিট জড়িয়ে ধরবেন এবং মুছে দিবেন।

জর বা খিচুনি থাকলে  (Febrile Convulsion) 

  • Suppository Ace (125mg) ব্যবহার করবেন।
  • মুখে কিছু খাওয়াবেন না।
  • ডান বা বাম কাতে শুয়ে রাখবেন।
  • মুখে ফেনা আসলে মুছে দিবেন।
  • বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ঔষধের মাত্রা ও বাড়াতে হবে।

[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ Sedil, Paracetamol ও Suppository ঔষধগুলো সব সময় পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ঘরে জমা রাখবেন।]

পেট কষা রোগীর জন্য উপদেশ 

  • বারবার পানি খাওয়াবেন।
  • বেশি চিনি দিয়ে দুধ খাওয়াবেন।
  • শাকসবজি, নিরামিষ, ভেজিটেবল সুপ বেশি বেশি খাওয়াবেন।
  • পাকা আম, পাকা পেঁপে, বেলের শরবত খাওয়াবেন।
  • প্রতিদিন একই সময়ে পায়খানা করানোর চেষ্টা করবেন।
  • ইসবগুলের ভুষি খাওয়াবেন।

ডায়রিয়া রোগের জন্য উপদেশ

  • ঘন ঘন ওরস্যালাইন এন বা রাইস স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
  • বুকের দুধ বন্ধ না করে ঘনঘন খাওয়াতে হবে।
  • কাশি হলে স্যালাইন খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।
  • পায়খানায় রক্ত দেখা দিলে এবং প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে শীঘ্রই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।

শ্বাসকষ্টের রোগীর জন্য উপদেশ

  • আইসক্রিম ফ্রিজের ঠান্ডা পানি কোল্ড ড্রিং ফ্রিজে রাখা খাবার খাওয়ানো নিষেধ।
  • ঠান্ডা পানিতে গোসল ঠান্ডা পানিতে হাতানো ঠান্ডা জায়গায় বা ধুলাবালিতে খেলাধুলা নিষেধ।
  • শরীরে কোন অবস্থাতেই ঘাম শুকাতে দিবেন না ঘাম তোয়ালে দিয়ে সাথে সাথে মুছে ফেলবেন।
  • ডাইরেক্ট ফ্যান বা ফ্যানের পাশে শোয়াবেন না।
  • ঘরে কার্পেট পাপোশ মশার কয়েল এবং স্প্রে ব্যবহার নিষেধ।
  • হালকা গরম পানি খাবে হালকা উষ্ণ পানিতে গোসল ও হাফ মুখ ধুবে।
  • বাচ্চার সামনে ঘর ঝাড়ু উঠান ঝাড়ু এবং ধূমপান নিষেধ।
  • গরুর মাংস হাঁসের ডিম ইলিশ মাছ চিংড়ি মাছ বেগুন কচু বা কচুর লতা খেলে শ্বাসকষ্ট বেশি হয় কিনা লক্ষ্য করুন।
  • বাড়িতে কুকুর বিড়াল রাখা নিষেধ।
  • সকালে ও বিকালে বেলুন ফলাবে অথবা মাউথ অরগান বাঁশি বাজাবে।
  • কখন কি করলে বাকি খেলে বাকি অবস্থায় কাশি শ্বাসকষ্ট বেশি হয় লক্ষ্য রাখুন এবং এড়িয়ে চলুন।
পরিশেষে বলা যায় শিশুর যত্নের জন্য উপরে নির্দেশিত উপদেশগুলো প্রাথমিকভাবে করণীয়। প্রাথমিক করণীয় শেষেও সমস্যার সমাধান না হলে যত দ্রুত সম্ভব অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আপনার শিশুর নিয়মিত পরিচর্যা করুন এবং শিশুকে সুস্থ রাখুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url