ডায়াবেটিস কমানোর প্রাকৃতিক উপায়
ডায়াবেটিস হলো একধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। শরীরের সেই অবস্থাকে ডায়াবেটিস হিসেবে ধরা হয় যখন শরীরে ইনসুলিন থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে পারে না বা ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যায়। ডায়াবেটিস সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে। টাইপ-১, টাইপ-২, জেস্টেশনাল এবং অন্যান্য। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে শরীরের ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যায়। যাদের শরীরে ইনসুলিন নষ্ট হয়ে গেছে তাদের যদি আলাদাভাবে ইনসুলিন দেয়া না হয় হলে তারা মারা যেতে পারেন।
আবার টাইপ-২ ডায়াবেটিসে শরীরে থাকা ইনসুলিন কাজ করতে পারে না। আমরা সারাদিন বাড়িতে ও বাইরের যে নানা ধরনের খাবার খাই, ফাস্ট ফুড খাই, তখন শরীরে একধরনের পরিবর্তন আসে। দেখা যায়, শরীরে ইনসুলিন আছে, কিন্তু সেটা কাজ করতে পারছে না। তখন আমরা যে খাবারই খাই, সেটার গ্লুকোজ জমে যায়।
ডায়াবেটিস কেন হয়?
আমরা যখন কোন খাবার খায় তখন সেই খাবারের অতিরিক্ত গ্লুকোজ কমিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের শরীরের প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। যখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় বা ইনসুলিন উৎপাদন হওয়ার পরও যখন কাজ করতে পারে না, তখন শরীরে খাবারের অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমা হতে থাকে। সেই অবস্থাকে আমরা ডায়াবেটিস ধরা হয়। খালি পেটে গ্লুকোজের সর্বোচ্চ মাত্রা হলো ৭ এবং ভরা পেটে গ্লুকোজের সর্বোচ্চ মাত্রা হলো ১১। শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা এর থেকে বেশি হলে সেটাকে ডায়াবেটিস হিসেবে ধরা হয়।
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো কি?
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো খুব সহজে প্রকাশ পায় এবং বোঝা যায়। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায় এবং ওজন কমে যায়। জটিলতা দেখা দেয় টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীদের বেলায়।অনেকেই বুঝতেই পারেন না যে তাঁদের ডায়াবেটিস আছে। বারবার প্রস্রাব করা, ঝিম ধরা ভাব, খাবার খেয়েও ক্ষুধা না মেটা, ক্লান্ত লাগা, কোথাও কেটে গেলে বা ঘা হলে সহজে সেটা না শুকানো—এ জাতীয় কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। ডায়াবেটিস আছে সেটা বুঝতে না পারায় এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসা না নেওয়ায় ৩-৪ বছরে অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে চোখের রক্ত জমে যায়। হার্টে ব্লক, যকৃতে ক্রিয়েটিনিন বেশি হয়।
ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার প্রাকৃতিক উপায়
ডায়াবেটিস শব্দটি এখন আমাদের কাছে বেশ কমন হয়ে পড়েছে। কারণ ডায়াবেটিস এখন আমাদের সমাজে মহামারির মতো দেখা দিয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যায় আমাদের আশেপাশে কারো না কারো ডায়াবেটিস আছেই। বয়স্ক, তরুণ সহ প্রায় সকল বয়সের মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এর প্রভাবে দিনে দিনে হৃদরোগ রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। টাইপ ১ ও টাইপ ২ উভয় ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ গুলো বুঝতে পারলে ঘরোয়া উপায়ে বা প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস কমানো সম্ভব।
ডায়াবেটিসের সাধারণ কিছু লক্ষণ হল-শরীরে সর্বদা ক্লান্তি অনুভব, ওজন কমে যাওয়া, অনেক বেশি পিপাসা লাগা, ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা, কাটা স্থান বা ক্ষত শুকোতে সময় লাগা এবং চোখে ঝাপসা দৃষ্টি। প্রতিদিনের অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড, চিনি, কার্বোহাইড্রেট খাওয়া, মদ পান, ধূমপান- এগুলো ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় বহুগুনে। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে এবং জীবনযাত্রায় খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনতে হবে।
ওষুধের ব্যবহার ছাড়া শুধুমাত্র ব্যায়াম, খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। চলুন জেনে নেয়া যাক কী খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে বা ডায়াবেটিস কমানোর প্রাকৃতিক উপায় কি?
পেঁয়াজ
ব্রিটিশ ওয়েবসাইট এক্সপ্রেস এর প্রতিবেদনে ডায়াবেটিস সম্বন্ধে বলা হয়েছে, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সস্তা এবং কার্যকর পদ্ধতি হলো পেঁয়াজ খাওয়া। পেঁয়াজের নির্যাস রক্তের ৫০ শতাংশ শর্করা কমাতে সক্ষম। পেঁয়াজে বিদ্যমান নির্যাস, অ্যালিয়াম সিপা এবং মেটফরমিন ডায়াবেটিসকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই তথ্য পাওয়া যায় মার্কিন গবেষণা পত্রে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত বেশি ব্যবহৃত একটি ওষুধ হলো মেটফরমিন। এই গবেষণার গবেষক পেঁয়াজকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য জিনিস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
নয়ন তারা উদ্ভিদ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নয়নতারা ফুলের গুরুত্ব অনেক। নয়ন তারা গাছের ফুল ও মূল প্রথমে শুকিয়ে নিন। এরপর ১ গ্রাম পরিমাণ শুকনো ফুল ও মূল মাঝারি মাপের ১ কাপ পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে পানিটা ছেঁকে ফুটিয়ে অর্ধেক পরিমাণ করুন। এরপর সেই পানি সকালে অর্ধেক এবং রাতে অর্ধেক পান করুন। এভাবে ১০ দিন পান করার পর পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। দেখবেন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়াসহ অন্যান্য উপসর্গগুলো কমতে শুরু করেছে। এভাবেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে।
পনির ফুল
পনির ফুলকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অব্যর্থ হিসেবে ধরা হয়। প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, পনির ফুল একটি বন্য প্রজাতির ফুল, যা সোলান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ফুলটি অগ্নাশয় এর বিটা পোস্টগুলোকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে যা শরীরে ইনসুলিন আরো ভালোভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হয়। শরীরে ইনসুলিনের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিদিন অল্প পরিমাণে এটি গ্রহণ করা যায়। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ টি ফুল এক গ্লাস পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রেখে সেই পানি ছেঁকে সকালে খালি পেটে পান করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।
করলা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সাহায্যকারী প্রাকৃতিক উপাদান গুলোর মধ্যে করলা অন্যতম। কারণ এটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে এবং ইনসুলিনের নিঃসরণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বীজ ফেলে দিয়ে দুই থেকে তিনটি করলার রস বের করে নিন। এরপর করলার রসের সাথে প্রতিদিন পানি মিশিয়ে সকালে খালি পেটে পান করুন। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে।
দারুচিনি
টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য দারুচিনি খুবই উপকারী। আমাদের শরীরের অগ্নাশয় যে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় দারুচিনি সেই প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। দারুচিনি গুড়া করে চা, পানি বা অন্য কোন পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে পান করতে পারলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
অ্যালোভেরা
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অ্যালোভেরা খুবই উপকারী। অ্যালোভেরা জেলে ফাইটোস্ট্যারলস নামক শক্তিশালী উপাদান থাকে। এই উপাদান ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। গবেষণায় ফাইটোস্ট্যারলসের অ্যান্টিহাইপার গ্লাইসেমিক প্রভাব পাওয়া যায় যা টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী। পানির সঙ্গে তেজপাতা, হলুদ ও অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করুন।
আমপাতা
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে আমপাতা বেশ কার্যকরী। প্রতিদিন ৩-৪ টি আম পাতা পানিতে ফুটিয়ে সকালে পান করলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আবার আমপাতা শুকিয়ে গুড়া করে রেখেও খেতে পারেন। প্রতিদিন দুইবার আধা চামচ আমপাতার গুড়া খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
মেথি
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ভালো একটি প্রাকৃতিক উপায় হলো মেথি। ২ টেবিল চামচ মেথি বীজ সারারাত একগ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এই মেথি বীজসহ পানি সকালে পান করুন। মেথি বীজে যে সকল জৈব উপাদান রয়েছে সেগুলো ইনসুলিনকে উদ্দীপিত করতে সক্ষম। এছাড়াও এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার। এই ফাইবার স্টার্চকে গ্লুকোজ এ পরিণত হতে বাধাগ্রস্থ করে। এভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
চর্বিযুক্ত মাছ
প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস কমাতে পারে চর্বিযুক্ত মাছ। চর্বিযুক্ত মাছের তালিকায় রয়েছে স্যালমন, সার্ডিন, হেরিং ইত্যাদি মাছ। এ সকল মাছে পর্যাপ্ত ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে এবং এ সকল মাছ ডিএইচএ এবং ইপিএ-এর বড় উৎস যা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। এইসব মাছ নিয়মিত খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে যায়। সর্বোপরি এ সকল মাছ খাওয়া শরীরের জন্য খুবই ভালো।
ডুমুর
পুষ্টিবিদদের মতে ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর ডুমুরের দারুন প্রভাব রয়েছে। ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকায় ডুমুর রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ রিসার্চ ইন ফার্মেসি অ্যান্ড বায়োসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, ডুমুরে হাইপোগ্লাইসেমিক উপাদান রয়েছে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে।
শরীরচর্চা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য শরীর চর্চার কোন বিকল্প নেই। একমাত্র ডায়াবেটিস রোগেই শরীর চর্চাকে ওষুধ হিসেবে দেখা হয়। একজন ডায়াবেটিসের রোগী যখন হাঁটতে শুরু করেন বা ব্যায়াম করতে শুরু করেন তখন রোগীর নিজের দেহের ইনসুলিন বেশি কাজ করতে শুরু করে। দেহের প্রতিটি কোষ তখন ইনসুলিনের প্রতি সেন্সিটিভ হয়ে যায়। তখন রোগীকে আর আলাদা করে ইনসুলিন নিতে হয় না।
একজন মানুষ একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে আর কখনোই পুরোপুরিভাবে এ রোগ সেরে ওঠেনা। শরীর ভালো রাখার জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করে এবং নিয়ম-কানুন মেনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞান এ রোগ পুরোপুরি নির্মূল করতে চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করে সফল হয়েছেন, তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতির যে ব্যয় তা বহন করা অল্প কয়েক শতাংশ মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষধ সেবন করুন এবং জীবনযাত্রায় নিয়মকানুন মেনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url