স্মৃতিতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
জন্ম এবং পরিচয়
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তাঁর ডাকনাম ছিল রেনু। পিতা শেখ জহুরুল হক ও মাতা হোসনে আরা বেগম। তিন বছর বয়সে পিতা পাঁচ বছর বয়সে মাতা এবং সাত বছর বয়সে লালন পালন কর্তা দাদাও মারা যান। মাত্র তিন বছর বয়সে চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে বিয়ের কথা হয় যা পরে আট বছর বয়সে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তিনি দুই কন্যা ও তিন পুত্রের জননী ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট লেডি।
পারিবারিক জীবন
দাদা মারা যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন শেখ ফজিলাতুন্নেছা কে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে সন্তান তুল্যে মানুষ করতে থাকেন। তাঁর দাদা শেখ মোহাম্মদ কাশেম বিয়ে দেয়ার সময়ই সব সম্পত্তি তাঁদের দুই বোনের নামে লিখে দিয়ে যান। এই সম্পদ তিনি পরিবার পরিচালনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে যেমন দিতেন তেমন দেশের কল্যাণে ব্যয় করতেন।
ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু যে পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছাও সেই একই পরিবেশে একই পরিবারে বড় হয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুজিবের আদর্শ, তাঁর সহজাত মানসিকতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাসী সত্ত্বা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। কিশোরী বয়সের মুগ্ধতা আর ভালোবাসায় সারা জীবন স্বামী মুজিবকে তিনি সকল ক্ষেত্রে সমর্থন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় তার লেখা এক চিঠির অংশবিশেষ ছিল এমন -
বঙ্গবন্ধুর চোখে রেনু
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন সঙ্গী সহধর্মিনীর কথা দিয়ে। তাকে আত্মজীবনী লেখার উৎসাহ আর উদ্যোগ দিয়েছেন বঙ্গমাতা। তিনি লিখেছেন -
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা অবিচ্ছিন্ন সত্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রন্থে মাযহারুল ইসলাম লিখেছেন -
বঙ্গবন্ধু বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন না বলে বাবা যখন রাগারাগি করছেন, সামান্য টাকা দিয়ে কলকাতা পাঠাচ্ছেন, তখন বিদায় বেলায় হাতের মুঠোতে নিজের জমির ধানের টাকা গুঁজে দিয়েছেন স্বামী বঙ্গবন্ধুর হাতে। এ গল্পও বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন।
৭ই মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গমাতার যে দৃঢ় অবস্থান এবং বঙ্গবন্ধুকে কারো কথা না শুনে দেশের জনগণের কথা মাথায় রেখে বক্তব্য দেয়ার যে পরামর্শ তা তাকে মহান করে তুলেছে। এই দৃশ্যের বর্ণনা আমরা পাই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বক্তব্য হতে।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "রেনু কিছু বলেনা কিন্তু তার এই কিছু না বলাটাই আমার বুকে বেশি ব্যথা দেয়।" তিনি বলেন, "এমনও দিন গেছে আমি জেলে চলে গেছি কিন্তু ঘরে এক আনা পয়সাও রেখে যেতে পারিনি। রেনু সব সামলে নিত।" কি বিশাল নির্ভরতার জায়গা। এভাবেই বঙ্গমাতা মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করেছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে আপন জনের সাথে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, একবার বঙ্গবন্ধু অনেক দিন জেলে ছিলেন তখন তিনি জেল গেটে বঙ্গবন্ধুকে বলেন -
এই মিষ্টিমধুর সম্পর্কে আজীবন বাধা ছিলেন তাঁরা দুজন। ড. নীলিমা ইব্রাহীম বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বইতে লিখেছেন -
পারিবারিক দায় দায়িত্ব
গ্রামের শশুর শাশুড়ির খবরাখবর, দেবর-ননদদের নানা সমস্যা সামলানো, গ্রামের মানুষের খোঁজ রাখা, সাহায্য করা, কেউ ভালো ফল করলে তাকে ঢাকায় এনে পড়ানো, কাকে বিয়ে দিতে হবে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি। আদর্শ গৃহিনী করে তাকে গড়ে তুলেছিলেন মাতা সায়েরা খাতুন।
ছোট মেয়ে শেখ রেহানার এক বক্তব্য হতে পাওয়া যায়, "আমার মা সবার খোঁজ রাখতেন কিন্তু তার নিজের একটা চুড়ি বা কোন শখ আহ্লাদ পূরণের দিকে কারো নজর ছিল না। তিনি তো এতিম ছিলেন।" বড় মেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণায় বলেন, "মা অবসরে নামাজ পড়তেন, গান শুনতেন আর গল্পের বই পড়তেন।"
মেয়েদের কোরআন শিক্ষার মৌলভী যেমন দিয়েছেন, তেমনি নাচ, সেতার বাজানো সবই শিখিয়েছেন শেখ রেহানার বক্তব্য হতে এমন তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু জেলে, ঘরে বাজার নাই এমন সময় তিনি খিচুড়ি আর আচার দিয়ে বাচ্চাদের বলতেন রোজ রোজ মাছ ভাত খেতে নেই। এমনই ধৈর্য নিয়ে তিনি তার পরিবার সামলেছেন কোন অভিযোগ ছাড়া।
জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি হতে পাই- গৃহবন্দী অবস্থায় শেখ হাসিনার প্রসব বেদনা উঠলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তখন তিনি যেতে চাইলে পাকিস্তানীরা বাধা দেয়। তিনি সেদিন ভীষণ কেঁদেছিলেন। কিন্তু ভেঙে পড়েন নি। সঠিক জায়গায় অর্থাৎ বেগম সুফিয়া কামালের কাছে খবরটি পৌঁছে দেন রান্না ঘরে জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির মাধ্যমে।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা
বাল্যকাল থেকে যে মানুষ গভীর মুগ্ধতায় বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন তাঁর মাঝে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় বাইরের খবর জেলের ভেতরে আর জেলের ভেতরের খবর বাইরে আনা নেওয়া করতেন। কোন বন্দীর কিছু খেতে ইচ্ছা হলেও তিনি রান্না করে নিয়ে যেতেন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চাইলে তিনি এর বিপরীতে দৃঢ় অবস্থান নেন। কোন ভীতি প্রদর্শন তাকে নত করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এ তথ্য মেলে।
৭১ এ তিনি বন্দি অবস্থায় দুই সৈনিকের সহযোগিতায় শেখ জামালকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠান। সেই দুই সৈনিকের যেন শাস্তি না হয় তার জন্য আবার মেজর তারাকে সুপারিশ করেন। ওয়াজেদ আলীর গ্রন্থ হতে এ তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সংগ্রামের সময় বন্দীদের পরিবারের খোঁজ রাখা, আর্থিক সাহায্য করা, উকিল ঠিক করা এসব কাজও তিনি করতেন।
২৩ মার্চ, ১৯৭১ জাতীয় পতাকা উত্তোলন নিয়ে যে দ্বিধার সৃষ্টি হয়েছিল সেখানেও তিনি বঙ্গবন্ধুকে সঠিক পরামর্শ প্রদান করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে তিনি পাকিস্তানের পতাকা নিজ হাতে পুড়িয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বলেন -
তখন বঙ্গমাতা এই বীরাঙ্গনাদের মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, আশ্রয় দিয়েছেন, স্নেহ দিয়েছেন তাদের। তিনি বলেন -
- দৈনিক বাংলার বাণী (১৭ই ফাল্গুন ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)
৬৬ এর ৬ দফার পক্ষে তিনি রাস্তায় নেমে লিফলেটও বিতরণ করেন যা প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য হতে প্রাপ্ত।
মমতাময়ী ও কঠিন বাস্তববাদী নারী
বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকা অবস্থায় যখন মাত্র তিন দিনের নোটিশে তাদের বাড়াবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় তখন কত কষ্ট সহ্য করেছেন তিনি, কিভাবে নিজের জমির ধান বিক্রির টাকা আর গৃহ ঋণ নিয়ে নিজ হাতে ৩২ নম্বর বাড়ি বানিয়েছেন তার উল্লেখ পাওয়া যায় বেবী মওদুদ লিখিত মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা বইতে। তিনি নিজ হাতে ইটে পানি দেয়া, দেয়ালে পানি দেয়া, শ্রমিকদের সাথে কথা বলা সব কাজ করতেন খরচ বাঁচানোর জন্য। বহু শ্রম, যত্ন ও মমতা দিয়ে তিনি ৩২ নম্বর বাড়িটি নির্মাণ করেন।
আব্দুল গাফফার চৌধুরী স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু পত্নী বইতে তাঁর আপ্যায়ন করার ধরন সম্পর্কে বলেছেন।গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের ইতিহাসের সহযাত্রী বইতে বিশিষ্ট সাংবাদিক আমানউল্লাহর জবানিতে পাওয়া যায় পরম মমতায় নিজ হাতে খাবার খাওয়ানোর কথা।
সন্তানদের কার, কখন কি প্রয়োজন সবই তিনি সময় মত খোঁজ রাখতেন। মাত্র ৪৫ বছরের জীবনকাল ছিল তার। নিজের সখ আহ্লাদ পূরণের জন্য কিছুই করেননি তিনি। বড়ই সাধারণ জীবন ছিল তাঁর।বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে জীবনের অধিকাংশ সময়ে কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃংখল মোচনে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় মানবী। পিতৃ মাতৃহীন এক অনাথ শিশু জীবন শুরু করেছিলেন শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। নিজের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে আজ তিনি এক মহীয়সী নারীর অনন্য উদাহরণ।
বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী হিসাবে শুধু নয় বরং একজন দক্ষ নারী সংগঠক হিসাবে। নিজেকে ধুপের মত বিলিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে যেমন ভূমিকা রেখেছেন তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় সম আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মাত্র ৪৫ বছর বয়সে এই মহীয়সী নারী ৩ পুত্র, ২ পুত্রবধূ এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ একদল বিপথগামী সেনার হাতে আজীবনের প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন। চিরশ্রদ্ধায় বাঙালি জাতি তাঁর অবদান স্বীকার করবে আজীবন।
T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url