শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা যা খাবেন না

শিশুকে বুকের দুধ পান করানো মায়েরা এমন অনেক কিছু খান যা খাওয়ার কারণে তার সোনামণির ঠিকমতো ঘুম হয় না। যেমন ধরুন ৩-৪ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের প্রায় সারাদিনই ঘুমিয়ে থাকা উচিত। অথচ অনেক সময় দেখা যায় দুধ খাওয়ানোর পর শিশুকে কিছুতেই ঘুম পাড়ানো যায় না। তাছাড়া প্রচন্ড কান্নাকাটিও করে।

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা যা খাবেন না

অবস্থা দেখে হয়ত আপনি শিশু ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার প্রথমেই আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কি প্রতিদিন কফি জাতীয় কিছু পান করেন। কারণ কফিতে থাকা ক্যাফিন এর প্রভাব ফেলে ছোট্ট সোনামনির শরীরে। মায়ের কফি পান শিশুর মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে, ঘুম কমিয়ে দিচ্ছে। যেসব শিশুরা মায়ের বুকের দুধ খায়, তাদের উপর মায়ের ডায়েট শিশুর উপর প্রভাব ফেলবেই।

ইংল্যান্ডের মিডলশেক্স হাসপাতালের প্রাক্তন সিনিয়র হাউজ অফিসার ড. জাকিয়া সুলতানা জানালেন, যতদিন না শিশু শক্ত খাবার খাচ্ছে ততদিন মায়ের নিয়ম মেনে খাওয়া দাওয়া করা উচিত। তাহলে জানতে চাইছেন কোন কোন খাবারগুলো এই সময়ে এড়িয়ে চলা উচিত?

কফি

শিশুকে স্তন্যপান যতদিন করাবেন ততদিন মায়ের ডায়েটে কফি না থাকাই উচিত। কফিতে ক্যাফিন নামক প্রাকৃতিক উত্তেজক থাকে। কফি পান করলে এই ক্যাফিন মায়ের দুধে প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের মত ক্যাফিন হজম করতে পারে না। ফলে এই উত্তেজক ছোট্ট সোনামনির মেজাজ বিগড়ে দেয়, চোখ থেকে কেড়ে নেয় ঘুম। মনে রাখবেন ক্যাফিনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে স্তন্যদুগ্ধে থাকা আয়রনের পরিমাণ কমে যায় এতে শিশুর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়।

চকলেট

চকলেট অনেকেরই প্রিয় একটি খাবার হলেও স্তন্যপানের সময় এটি মোটেও মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। চকলেট এর মধ্যে রয়েছে থিওব্রোমিন নামক পদার্থের প্রভাব। ক্যাফিনের মতই থিওব্রোমিন শিশুর মেজাজ বিগড়ে দেয়। ছোট্ট সোনামণির খাওয়া-দাওয়া পর অশান্ত হয়ে পড়ে, কান্নাকাটি করে। ড. জাকিয়ার মতে, চকলেট খাওয়া যেতেই পারে, তবে কতটা পরিমাণে তা নির্ভর করবে শিশুর মেজাজ এর উপর। যতটা খেলে শিশুর মেজাজে কোন প্রভাব ফেলবে না, তার বেশি না খাওয়াই ভালো। দিনে ৭০০ মিলিগ্রামের বেশি থিওব্রোমিন শরীরে গেলে সোনামণির ঘুম কমে যেতে পারে।

অ্যালকোহল

অ্যালকোহল ছোট সোনামণির স্নায়ূকোষের বৃদ্ধি আটকে দেয়। স্তন্যপান করানোর সময় মা যদি আলকোহল পান করেন তাহলে স্তন্যদুগ্ধের মাধ্যমে তা বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করে। তাই শিশুর সুরক্ষার কথা ভেবে এই সময় অ্যালকোহল পান বন্ধ রাখা উচিত। তবে এটি অন্য সময়ও পরিহার করা উচিত।

বাঁধাকপি, ফুলকপি ও ব্রকলি

বাঁধাকপি, ফুলকপি বা ব্রকলি জাতীয় সবজি খেলে খাদ্যতন্ত্রে যথেষ্ট অ্যাসিডিটি হয়। এছাড়াও ডাল, পেঁয়াজ, বিনসও এসিডিটির কারণ। মায়ের এসিডিটি হলে পরদিন শিশুর এসিডিটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের দুধের মধ্যে দিয়েই এই এসিডিক উপাদান শিশুর ছোট্টদেহে প্রবেশ করে। তাই এসিড উৎপাদনকারী খাবার স্তন্যপান করানোর পর্বে এড়িয়ে চলা উচিত।

হাই মার্কারি মাছ

বেশি পরিমাণে পারদ বা মার্কারি রয়েছে এমন মাছ স্তন্যপান করানোর পর্বে না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ড. জাকিয়া। তিনি বলেন, মার্কারি মায়ের দুধের মাধ্যমে ছোট্ট সোনামনির শরীরে ঢুকে যায়। এতে শিশুর নার্ভের গঠনে বাধা তৈরি হয়। বরং বাজার থেকে জ্যান্ত মাছ কিনে তা রান্না করে খাওয়াটা এই সময় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ।

টক ফল

শিশুকে স্তন্যপান করানোর পর্বে টক জাতীয় ফল খাওয়া পরিহার করবেন। কমলালেবু, আনারস, সরবতি লেবু, আম, পেঁপে ইত্যাদিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। মা হওয়ার পর ভিটামিন সি মায়ের শরীরের জন্য ভালো। তবে টক জাতীয় ফল খেলে এসিডিটি হতে পারে যা মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রভাব ফেলে। মনে রাখবেন ছোট্ট সোনামনির খাদ্যতন্ত্র অপরিণত হয়। অপরিণত খাদ্যতন্ত্র অ্যাসিডিটি হলে ওর জন্য সেটি খুবই কষ্টকর। তাই বিশেষজ্ঞরা শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়ানোর আগে পর্যন্ত মাকে টক জাতীয় ফল না খাওয়ার পরামর্শ দেন।

পিনাট

পিনাট খাবার হিসেবে বেশ সুস্বাদু। কিন্তু এতে রয়েছে এলার্জিক প্রোটিন। মা পিনাট খেলে এই এলার্জিক প্রোটিন ব্রেস্ট মিল্কে মিশে যায় যা শিশুর দেহে গিয়েও অ্যালার্জি ছড়িয়ে দিতে পারে। এতে শিশুর গায়ে চুলকানি হতে পারে। এমনকি ওর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতে পারে। এছাড়াও ভবিষ্যতে শিশুর পিনাটে এলার্জি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই স্তন্যপানের পর্বে পিনাট বা পিনাট দিয়ে তৈরি কোন খাবার মায়ের খাওয়া উচিত হবে না।

মসলাদার খাবার

ঝাল-মসলা বাচ্চার অপরিণত খাদ্যতন্ত্র মোটেই সহ্য করতে পারেনা। তাই মায়ের খাবারে মসলা থাকলে তা ছোট্ট সোনামণির জন্য মোটেই ভালো নয়। সামান্য গরম মসলা গুঁড়ো মায়ের খাবারে থাকলে তা শিশুর খাদ্যতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। বাচ্চাকে শক্ত খাবার খাওয়ানোর আগে পর্যন্ত তাই মায়ের খাবারের রেসিপিতে মসলা না রাখাই উচিত।

রসুন

রসুনের গন্ধে অনেক শিশুর যেমন অসুবিধা হয় না, তেমনি অনেকেই আবার সহ্য করতে পারে না। মায়ের খাবারের রসুন থাকলে তার প্রভাব বুকের দুধেও পড়ে। তাই রসুন খাওয়ার পর নজর রাখুন সোনামণি বুকের দুধ খাওয়ার সময় অস্বস্তি বোধ করছে কিনা। তেমনটা হলে মায়ের ডায়েটে রসুন ছাড়া রান্না থাকা ভালো।

ডেইরি দ্রব্য

শিশুকেই স্তন্যপানের পর্বে মা গরুর দুধ থেকে তৈরি কোন খাবার খেলে মায়ের দুধের মধ্য দিয়ে তা সন্তানের দেহে যায়। অনেক শিশুর খাদ্যনালী গরুর দুধ সহ্য করতে পারে না। তাই মা ডেইরি দ্রব্য খাওয়ার পর স্তন্যপান করালে শিশু কলিক হতে পারে, দুধ বমি করে দিতে পারে। আসলে দুধের এলার্জেন শিশুর খাদ্যনালীতে গন্ডগোল পাকিয়ে দেয়। তাই এমনটা হলে চিকিৎসকরা মায়ের ডায়েট থেকে ডেয়ারি দ্রব্য বাদ দেয়ার পরামর্শ দেন।

প্রসেস করা খাবার

প্রসেস বা প্রক্রিয়াজাত খাবার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পর্বে একেবারেই মায়ের খাওয়া উচিত নয়। এই ধরনের খাবারে মেশানো থাকে নানা রকমের প্রিজারভেটিভস। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রিজারভেটিভস এ থাকা রাসায়নিক পদার্থ যেমন ব্রেস্ট মিল্কে প্রভাব ফেলে, তেমনি শিশুর শরীরেরও ক্ষতি করতে পারে।

এতগুলো খাবার সম্পর্কে শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই মায়েরা একটু হকচকিয়ে যেতে পারেন। এ অবস্থায় কোন খাবারটা আপনার শিশুর জন্য ভালো, আর কোনটা ভালো নয় তা কি করে বুঝবেন তাই তো? ড. জাকিয়া বললেন, কয়েকটি বিষয় মনে রাখলে আপনি নিজেই আপনার ডায়েট কেমন হওয়া উচিত তা বুঝতে পারবেন।যেমন- বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় ছোট্ট সোনার উপর নজর রাখুন। প্রতিদিন দুধ খাওয়ার পর আপনার শিশুটি কেমন আচরণ করছে তা লক্ষ্য রাখুন। ওর যদি কান্নাকাটি, বমি, ঘুম না আসা বা ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা যায় তাহলে বোঝা যাবে মায়ের খাবারে কি কি পরিবর্তন আনা উচিত।

পরিশেষে আরেকটি উল্লেখ্য বিষয় হলো, স্তন্যপান করানোর পর্বে একটি খাবারের ডায়েরি লেখা সব মায়েদেরই উচিত। এই ডাইরিতে লিখে রাখুন কোন খাবার খাওয়া যাবে, কোন খাবার খাওয়া যাবে না। আপনি যে খাবার গুলো খেলে আপনার ছোট্ট সোনামণির সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর নামও লিখে রাখুন। এমনকি কোন খাবার কতটা খেলে বা কখন খেলে শিশুর দুধ খাওয়ার পর কোন অসুবিধা হচ্ছে না সেটাও লিখে রাখতে পারেন আপনার ডায়েরিতে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url