হিটস্ট্রোক কি? হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে যা করবেন
তীব্র তাপদাহ বা গরমে নাভিশ্বাস উঠে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিনই হবে বোধহয়। বাইরে যারা কাজ করেন তারা তো কষ্টে আছেনই আর যারা ঘরে থাকেন তাদেরও স্বস্তি থাকে না ভয়াবহ লোডশেডিং এর কারণে। আর এই গ্রীষ্মকালীন তাপদাহ বা গরম আবহাওয়ায় একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে হিটস্ট্রোক।
হিটস্ট্রোক সম্বন্ধে আমাদের সকলেরই মোটামুটি একটু ধারণা আছে। আজকে আমরা এই আর্টিকেলে হিটস্ট্রোক কি, হিটস্ট্রোক কেন হয় এবং হিটস্ট্রোক হলে করনীয় কি সে সম্বন্ধে আপনাদেরকে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। আসুন জেনে নেই হিটস্ট্রোক কি, হিটস্ট্রোকে কাদের হয় আর হলে তাৎক্ষণিকভাবে আপনি কি করবেন।
হিটস্ট্রোক কী?
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর তথ্য অনুযায়ী তীব্র তাপদাহ বা গরমের সবচেয়ে মারাত্মক অসুস্থতা হচ্ছে হিটস্ট্রোক। অতিরিক্ত গরমে শরীর যখন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তখন মানুষ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এর ফলে দেহের তাপমাত্রা ভীষণ বেড়ে যায়, শরীরে ঘাম হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং শরীর নিজে নিজে ঠান্ডা হতে পারেনা। কেউ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে দেহের তাপমাত্রা ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছাতে পারে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি যদি সময়মতো চিকিৎসা না পান তাহলে হিটস্ট্রোকের কারণে স্থায়ী প্রতিবন্ধিতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
হিটট্র্রোকের কারণ
অতিরিক্ত গরমের কারণে যে কারোরই হিটস্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু বিষয় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বয়স। তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা নির্ভর করে আপনার শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর। এ কারণে শিশুদের এই স্নায়ুতন্ত্র পুনর্গঠিত থাকেনা এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে বা ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এদের বেশি থাকে।
গরম আবহাওয়ায় বেশিক্ষণ ধরে সক্রিয় থাকলে বা কোনো প্রশিক্ষণ করলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। হঠাৎ করেই ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে গরম আবহাওয়ায় গিয়ে পড়লেও হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেমন শীতের দেশ থেকে গরম কোন দেশে ভ্রমণ করলে এই ঝুঁকি তৈরি হয়।আবার ঘর ঠান্ডা করার যন্ত্র না থাকলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। পাখা কিছুটা স্বস্তি দিলেও তা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি খুব একটা কমায় না।
কিছু কিছু ওষুধ সেবন আপনার শরীরের তাপমাত্রার প্রতি সহনশীলতা কমাতে পারে, পানিশূন্যতা বাড়াতে পারে। তাই শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা বা হূদরোগ কিংবা বিষন্নতার ওষুধ নিয়মিত যারা খাচ্ছেন তীব্র তাপদাহ বা গরমে তাদেরকে অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যারা হূদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, শরীরের ওজন অনেক বেশি বা ফুসফুসের জটিলতা আছে তাদের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
হিটস্ট্রোকের লক্ষণ
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি এর তথ্য অনুযায়ী কেউ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তার মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে-
- বিভ্রান্তি বা মানসিক অসংলগ্ন অবস্থা, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা
- চেতনা হারিয়ে ফেলা
- শরীরের চামড়া গরম হয়ে যাওয়া, শুকনো হয়ে যাওয়া এবং অপরিমিত ঘাম হওয়া
- শরীর অবশ হয়ে যাওয়া
- শরীরের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া
শিশু এবং বড়দের মধ্যে হিটস্ট্রোকের লক্ষণ একই রকম থাকে। তবে শিশুরা অস্বস্তিতেও ভুগতে পারে। কারও মধ্যে হিটস্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে তাকে ঠান্ডা করে তরল খাওয়াতে হবে।
কারো হিটস্ট্রোক হলে যা করবেন
কারো হিটস্ট্রোক হলে যত দ্রুত সম্ভব কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যথা সময়ে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হবে। পদক্ষেপগুলো হচ্ছে-
- যত দ্রুত সম্ভব হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি ঠান্ডা স্থানে নিয়ে যাওয়া।
- শরীর থেকে অতিরিক্ত কাপড় খুলে ফেলা। যেমন- চাদর বা মোটা জ্যাকেট বা ভারী কাপড় খুলে ফেলতে হবে।
- ঠান্ডা পানি বা পানিশূন্যতা দূর করে এমন পানীয় বেশি করে খাওয়াতে হবে।
- যত দ্রুত সম্ভব শরীর ঠান্ডা করতে হবে। এর জন্য বাতাস করা যেতে পারে, কাপড় বা স্পঞ্জ ভেজিয়ে গা মোছা যায়, ঠান্ডা কোন মোটা কাপড়ে মুড়িয়ে ফেললে ভালো হয়।
এছাড়া বরফ ঠান্ডা কোন ব্যাগ বগলের নিচে এবং ঘাড়ে লাগিয়ে রাখলে শরীর ঠান্ডা হয়। এগুলো সম্ভব না হলে ঠাণ্ডা পানিতে পুরো শরীর ভিজিয়ে ফেলতে হবে। এর জন্য গোসল একটি ভালো উপায়। যতক্ষণ পর্যন্ত হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত কেউ স্বাভাবিক না হয় ততক্ষণ তাদের সাথে থাকুন। সাধারণত ৩০ মিনিটের মধ্যেই তারা আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ অনুভব করার কথা। তবে ৩০ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরও যদি কারো অবস্থার উন্নতি না হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যেসব লক্ষণ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেবেন
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী হিটস্ট্রোকের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ দেখলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো আছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে-
- আধাঘন্টা বা ৩০ মিনিট ঠান্ডা কোন স্থানে বিশ্রাম নেয়ার পর, তরল খাবার পরও যদি আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ বোধ না করেন
- শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়
- শরীরের ত্বক গরম হয়ে যায়
- চামড়া লাল হয়ে যায় বা ঘাম না হয়
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়
- দ্রুত শ্বাস নেয় কিংবা শ্বাসকষ্ট হয়
- বিভ্রান্তি দেখা দেয়া বা অসংলগ্ন আচরণ হয়
- ফিট হয়ে যাওয়া
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে যা করবেন
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ করতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। এগুলো হচ্ছে-
- আপনি যদি খুব একটিভ হয়ে থাকেন বা ব্যায়াম করেন তাহলে বেশি পরিমাণে ঠান্ডা তরল পান করতে হবে।
- হালকা রঙের ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে।
- সকাল ১১ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত সূর্যের সরাসরি তাপ এড়িয়ে চলতে হবে।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
- অতিরিক্ত কঠিন শরীরচর্চা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- অতিরিক্ত গরমের সময় যদি বাইরের তুলনায় আপনার ঘরের পরিবেশ তুলনামূলক ঠাণ্ডা হয়ে থাকে তাহলে ঘরের পর্দা নামিয়ে রাখুন। জানালা বন্ধ করে রাখুন এবং ঘরের পরিবেশ গরম করতে পারে এমন কোন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি যেমন লাইট বন্ধ করে রাখুন।
এসব পদক্ষেপ আপনার পানিশূন্যতা রোধ করবে এবং আপনার শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবে। শিশু ও বয়স্ক বা যাদের ডায়াবেটিস আছে বা হৃদরোগের মত স্বাস্থ্য সমস্যা আছে তাদের হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। তাই সাবধানে থাকুন ভালো থাকুন।
T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url