স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ৮টি পরামর্শ

একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মূল হলো আপনার শারীরিক কার্যক্রমের মাত্রা অনুযায়ী সঠিক পরিমাণ ক্যালরি খাওয়া, যাতে আপনি যতটা শক্তি গ্রহণ করেন ঠিক ততটাই ব্যবহার করতে পারেন। আপনি যদি শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খান বা পান করেন, তবে ওজন বেড়ে যাবে, কারণ অতিরিক্ত শক্তি শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হয়। আর যদি খুব কম খান বা পান করেন, তবে আপনার ওজন কমে যাবে—বলেছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)।

স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ৮টি পরামর্শ

সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পুষ্টি পেতে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়া জরুরি। এনএইচএস (NHS) ইউকে সুপারিশ করেছে যে পুরুষদের দৈনিক প্রায় ২,৫০০ ক্যালরি (১০,৫০০ কিলোজুল) গ্রহণ করা উচিত। নারীদের দৈনিক প্রায় ২,০০০ ক্যালরি (৮,৪০০ কিলোজুল) গ্রহণ করা উচিত।

এই স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের জন্য নিম্নলিখিত আটটি পরামর্শ প্রকাশ করেছে।

আপনার খাবারের ভিত্তি হোক উচ্চ-আঁশযুক্ত শর্করা

শর্করা-সমৃদ্ধ খাবার আপনার খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের একটু বেশি হওয়া উচিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আলু, রুটি, ভাত, পাস্তা এবং সিরিয়াল। উচ্চ আঁশযুক্ত বা সম্পূর্ণ শস্যজাত খাবার বেছে নিন। যেমন- ব্রাউন রাইস বা খোসাসহ আলু। এগুলোতে সাদা বা পরিশোধিত শর্করার তুলনায় বেশি আঁশ থাকে এবং এগুলো আপনাকে দীর্ঘক্ষণ তৃপ্ত থাকতে সাহায্য করে।

প্রতিটি প্রধান খাবারের সঙ্গে অন্তত একটি শর্করা-সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করুন। অনেকেই মনে করেন শর্করা-সমৃদ্ধ খাবার ওজন বাড়ায়, তবে আসলে গ্রাম প্রতি হিসেবে এগুলোর ক্যালরির পরিমাণ ফ্যাটের অর্ধেকেরও কম। তবে রান্না করার সময় বা পরিবেশন করার সময় আপনি যে চর্বি যোগ করেন সেদিকে খেয়াল রাখুন, কারণ সেটিই ক্যালরির পরিমাণ বাড়ায়—যেমন চিপসে তেল, রুটিতে মাখন বা পাস্তায় ক্রিমযুক্ত সস।

প্রচুর ফল ও সবজি খান

প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ রকমের ফল ও সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলো হতে পারে টাটকা, হিমায়িত, ক্যানজাত, শুকনো বা জুস আকারে। আপনার প্রতিদিনের "৫ এ ডে" (৫ ধরনের ফল ও সবজি) পূরণ করা আসলে যতটা কঠিন মনে হয়, ততটা নয়। উদাহরণস্বরূপ, নাশতায় সিরিয়ালের ওপর একটি কলা কেটে নিতে পারেন বা সকালের নাস্তার সময়কার স্ন্যাক্সের বদলে একটি টাটকা ফল খেতে পারেন।

স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ৮টি পরামর্শ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সকালের নাশতায় একটি কলা রুটি বা পরোটার ভেতরে মুড়ে খাওয়াও কার্যকর হতে পারে। একক পরিমাণ টাটকা, ক্যানজাত বা হিমায়িত ফল ও সবজি মানে ৮০ গ্রাম। শুকনো ফলের একটি পরিমাণ (যা কেবল মূল খাবারের সময় খাওয়া উচিত) হলো ৩০ গ্রাম। ১৫০ মিলিলিটার ফলের রস, সবজির রস বা স্মুদি একটি পরিমাণ হিসেবে ধরা হয়। তবে দিনে এক গ্লাসের বেশি খাওয়া উচিত নয়, কারণ এসব পানীয়তে চিনি বেশি থাকে এবং দাঁতের ক্ষতি করতে পারে।

বেশি মাছ খান, বিশেষ করে চর্বিযুক্ত মাছ

মাছ হলো প্রোটিনের ভালো উৎস এবং এতে রয়েছে বহু ভিটামিন ও খনিজ। সপ্তাহে অন্তত দুটি মাছ খাওয়ার লক্ষ্য রাখুন, যার মধ্যে অন্তত একটি হবে তেলযুক্ত মাছ। তেলযুক্ত মাছ ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। বেশিরভাগ মানুষের বেশি মাছ খাওয়া উচিত, তবে কিছু প্রকার মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও চিনি কমান

স্যাচুরেটেড ফ্যাটঃ খাদ্যে কিছুটা ফ্যাট প্রয়োজন, তবে কতটা এবং কী ধরনের ফ্যাট খাচ্ছেন, সেদিকে নজর রাখা জরুরি। ফ্যাটের মূলত দুটি ধরন আছে: স্যাচুরেটেড (সন্তৃপ্ত) ও আনস্যাচুরেটেড (অসন্তৃপ্ত)। অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। গড়ে পুরুষদের দিনে সর্বোচ্চ ৩০ গ্রাম এবং নারীদের দিনে সর্বোচ্চ ২০ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ করা উচিত।

স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ৮টি পরামর্শ

১১ বছরের নিচের শিশুদের বড়দের তুলনায় কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট খাওয়া উচিত। তবে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্য কম-ফ্যাটযুক্ত খাদ্য উপযোগী নয়। দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য পূর্ণ-চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার (যেমন চিজ ও দই) খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

স্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায় অনেক খাবারে, যেমন:

  • চর্বিযুক্ত মাংস
  • মাখন
  • ঘি
  • শক্ত চিজ
  • ক্রিম
  • কেক
  • বিস্কুট
  • সসেজ
  • পাই

স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম খান এবং এর পরিবর্তে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার বেছে নিন, যেমন উদ্ভিজ্জ তেল ও স্প্রেড, তেলযুক্ত মাছ এবং অ্যাভোকাডো। মাখন বা ঘির পরিবর্তে সামান্য উদ্ভিজ্জ তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন—এটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প। মাংস খাওয়ার সময় চর্বি কেটে ফেলুন এবং চর্বিহীন মাংস বেছে নিন। সব ধরনের ফ্যাট উচ্চ-শক্তি সম্পন্ন, তাই অল্প পরিমাণেই খাওয়া উচিত।

চিনিঃ চিনি-সমৃদ্ধ খাবার ও পানীয় নিয়মিত খেলে স্থূলতা ও দাঁতের ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে। চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় সাধারণত অনেক ক্যালরি বহন করে, ফলে ঘন ঘন খেলে ওজন বাড়াতে পারে। বিশেষত খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে খেলে দাঁতের ক্ষয় হতে পারে।

ফ্রি সুগার হলো সেই চিনি, যা খাবার বা পানীয়তে যোগ করা হয় বা প্রাকৃতিকভাবে মধু, সিরাপ ও আনসুইটেন্ড ফলের রস ও স্মুদিতে পাওয়া যায়। এই ধরনের চিনি কমাতে হবে, ফল ও দুধে থাকা প্রাকৃতিক চিনি নয়। অনেক প্যাকেটজাত খাবার ও পানীয়তে অবাক করার মতো বেশি ফ্রি সুগার থাকে।

ফ্রি সুগার পাওয়া যায় যেমন খাবারে:

  • চিনিযুক্ত কোমল পানীয়
  • চিনিযুক্ত ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল
  • কেক
  • বিস্কুট
  • পেস্ট্রি ও পুডিং
  • মিষ্টি ও চকলেট
  • অ্যালকোহলিক পানীয়

খাবারের লেবেল সাহায্য করতে পারে। এগুলো দেখে বুঝে নিন খাবারে কতটা চিনি রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রামে যদি ২২.৫ গ্রাম বা তার বেশি চিনি থাকে তবে তা উচ্চ-চিনিযুক্ত, আর ৫ গ্রাম বা তার কম থাকলে নিম্ন-চিনিযুক্ত বলে ধরা হয়।

কম লবণ খানঃ প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম

অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়ায়। উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। আপনি খাবারে লবণ না দিলেও অজান্তে বেশি লবণ খেয়ে ফেলতে পারেন। আপনার খাওয়া লবণের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ থাকে কেনার সময় খাবারের ভেতরেই—যেমন ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, স্যুপ, রুটি ও সস। খাবারের লেবেল দেখে লবণ কমান। প্রতি ১০০ গ্রামে ১.৫ গ্রাম বা তার বেশি লবণ থাকলে সেটি উচ্চ-লবণযুক্ত খাবার। প্রাপ্তবয়স্ক ও ১১ বছরের ঊর্ধ্বে শিশুদের দিনে সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম (প্রায় এক চামচ) লবণ খাওয়া উচিত। ছোটদের আরও কম খাওয়া দরকার।

সক্রিয় থাকুন এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন

সুস্থভাবে খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা টাইপ–২ ডায়াবেটিস, কিছু ধরনের ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। আবার খুব কম ওজনও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।

বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্যালরি কম খেয়ে ওজন কমাতে হয়। যদি ওজন কমানোর চেষ্টা করেন, তাহলে কম খান এবং বেশি সক্রিয় থাকুন। একটি স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস আপনাকে স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করবে। আপনার স্বাস্থ্যকর ওজন আছে কিনা তা জানতে বিএমআই ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন।

এনএইচএস ইউকে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে একটি বিনামূল্যের ওজন কমানোর পরিকল্পনাও দেয়। এটি ১২-সপ্তাহের একটি গাইড, যেখানে স্বাস্থ্যকর খাবার ও শারীরিক কার্যক্রম নিয়ে পরামর্শ থাকে।

শরীরে পানির ঘাটতি হতে দেবেন না

শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত তরল পান করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ৬ থেকে ৮ গ্লাস পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর বাইরে খাবার থেকেও তরল পাওয়া যায়। সব ধরনের নন-অ্যালকোহলিক পানীয় ধরা হয়, তবে পানি, কম-চর্বিযুক্ত দুধ এবং কম-চিনিযুক্ত পানীয় (যেমন চা ও কফি) হলো স্বাস্থ্যকর বিকল্প।

চিনিযুক্ত কোমল ও ফ্রিজিং ড্রিঙ্কস এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে ক্যালরি বেশি এবং দাঁতের ক্ষতি করে। এমনকি আনসুইটেন্ড ফলের রস ও স্মুদিতেও ফ্রি সুগার বেশি থাকে। ফলের রস, সবজির রস ও স্মুদির মোট পরিমাণ দিনে ১৫০ মিলিলিটারের বেশি হওয়া উচিত নয় (একটি ছোট গ্লাস)। গরম আবহাওয়ায় বা ব্যায়াম করার সময় আরও বেশি তরল পান করতে মনে রাখবেন।

কখনো সকালের নাস্তা বাদ দেবেন না

অনেকেই মনে করেন সকালের নাস্তা বাদ দিলে ওজন কমবে। কিন্তু একটি স্বাস্থ্যকর নাশতা—যেটি উচ্চ-আঁশযুক্ত, কম-চর্বিযুক্ত, কম-চিনিযুক্ত ও কম-লবণযুক্ত—সুষম খাদ্যের অংশ হতে পারে এবং সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url